❒ অবতরণিকা / উপস্থাপনা / ভূমিকাঃ
.
বর্তমান রাজকীয় সৌদি আরবের উল্লেখযোগ্য প্রধান সোনার মদিনাহ খ্যাত একটি শহর। পবিত্র নগরী মদিনা মুসলিম উম্মাহর কাছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ শহর। মুসলিম হৃদয়ে এই নগরীর প্রতি রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মর্যাদা। কেননা এখানেই শায়িত আছেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)। পবিত্র এই ভূমিতেই ইসলামের উত্থান হয়েছিল এবং এখান থেকেই সারা পৃথিবীতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। আল্লাহর সন্তুষ্টি, ইসলাম ও ইসলামী কল্যাণময় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্যই মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ) মাতৃভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। তিনি তাঁর জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নবুওয়তির শেষ ১০ বছর এই নগরীতেই কাটিয়েছেন। মূলত আল্লাহ এই নগরীকে ইসলামের জন্য কবুল করেছিলেন। আল্লাহ তা‘য়ালা ও তাঁর রাসুল (সাঃ) পবিত্র এই নগরের বহুবিধ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেছেন।
.
সৌদি আরবে হজ্জ ও উমরাহ করা, মক্কা নগরীর কা‘বা ও মদিনাহ যিয়ারত (পরিদর্শন) করা, ইসলামী ও নবীদের স্মৃতি-বিজড়িত স্থানসমূহ যিয়ারত (পরিদর্শন) করা প্রতিটি মানুষের জীবনের একান্ত চাওয়া, কামনা, মনোবাসনা, আকাঙ্খা প্রতিনিয়তই হৃদয়ে জাগরুক থাকে। হে আল্লাহ! আমার মতো অধম. অক্ষম ও হত-দরিদ্র ব্যক্তিসহ সকলকেই হজ্জ ও উমরাহ করার সামর্থ ও তাওফীক দান কর, আমীন।
.
.
❒ মদিনায় মৃত্যু কামনা করার দু‘আ / দুয়াঃ
.
উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি এ বলে দু‘আ করতেন :
.
اَللهم ارْزُقْنِيْ شَهَادَةً فِيْ سَبِيْلِكَ، وَاجْعَلْ مَوْتِيْ فِيْ بَلَدِ رَسُوْلِكَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
.
(উচ্চারণ : আল্লাহুম্মার যুক্বনী- শাহাদাতান ফী- সাবিলিকা, ওয়াজ‘আল মাওতী- ফী- বালাদি রাসূলিকা (সাঃ)। অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে তোমার রাস্তায় শাহাদাত লাভের তাওফীক দান কর এবং আমার মৃত্যু তোমার রাসূলের শহরে প্রদান কর। [সহীহ বুখারী ১৮৯০ (শামিলা ও তা. পা), ১৭৬৬ (ই. ফা), ১৭৫৫ (আ. প্র)]।
.
.
❒ মদিনার সম্মান ও মর্যাদা সমূহঃ
.
● বিশ্বের সর্বাধিক নিরাপদ নগরী হচ্ছে মদিনাহ :
.
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘য়ালা মদিনার প্রবেশদ্বারগুলোতে ফেরেশতাদের মধ্য থেকে প্রহরী নিযুক্ত করেছেন, যাঁরা এতে মহামারি, বিপদ-আপদ ও দাজ্জালের প্রবেশ প্রতিহত করবেন। আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
.
عَلٰى أَنْقَابِ الْمَدِيْنَةِ مَلاَئِكَةٌ لاَ يَدْخُلُهَا الطَّاعُوْنُ وَلاَ الدَّجَّالُ
.
‘মদিনার পথে-প্রান্তরে রয়েছে (প্রহরী) ফেরেশতারা, (তাই) এখানে মহামারি ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না।’ [সহীহ বুখারী ১৮৮০ (শামিলা ও তা. পা), ১১৭৮ ও ৬৬৪৮ (ই. ফা), সহীহ মুসলিম ৩২২০ (ই. ফা)]।
.
● মদিনায় মৃত্যু হওয়া বা মৃত্যু বরণ করা ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর শাফায়াত (সুপারিশ) লাভে ধন্য হবে :
.
মদিনায় মৃত্যু হওয়া বা মৃত্যু বরণ করা ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর শাফায়াত (সুপারিশ) লাভে ধন্য হবে। হাদিসে মদিনায় মৃত্যুবরণকারীর মর্যাদার কথা এসেছে। ইবনু উমার (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
.
مَنِ اسْتَطَاعَ أَنْ يَمُوْتَ بِالْمَدِيْنَةِ فَلْيَمُتْ بِهَا فَإِنِّيْ أَشْفَعُ لِمَنْ يَّمُوْتُ بِهَا
.
‘যে ব্যক্তি মদিনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম, সে যেন তা করে। কেননা যে তথায় মৃত্যুবরণ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াত (সুপারিশ) করব।’ [মুসনাদে আহমাদ ৫৮১৮, তিরমিযী ৩৯১৭ (তাহক্বীক্বকৃত), ইবনু মাজাহ ৩১১২]।
.
● মদিনায় মৃত্যু বরণকারী মুসলিম হলে অবশ্যই রাসলূ (সাঃ) তার সুপারিশ করবেন :
.
আবূ সাঈদ মাওলা যাহরী (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি আল হাররার রাতগুলোতে আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) এর নিকট এলেন এবং মদিনা থেকে (কোথাও) চলে যাওয়ার পরামর্শ করলেন। তিনি তাঁর কাছে এখানকার দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নিজের বৃহৎ পরিবারের অভিযোগ করলেন। তিনি তাকে আরও জানালেন যে, তিনি এখানকার ক্লেশ ও রুক্ষ আবহাওয়া বরদাশত করতে পারছেন না। আবূ সাঈদ (রাঃ) তাঁকে বললেন :
.
لَا يَصْبِرُ أَحَدٌ عَلٰى لَأْوَائِهَا فَيَمُوْتَ إِلَّا كُنْتُ لَهُ شَفِيْعًا أَوْ شَهِيْدًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا كَانَ مُسْلِمًا
.
তোমার জন্য দুঃখ হয়, আমি তোমাকে মদিনা ত্যাগের পরামর্শ দিতে পারি না। কারণ, আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি এখানকার কষ্টসহ্য করে মৃত্যুবরণ করবে, কিয়ামতের দিন অবশ্যই আমি তার জন্য শাফাআত করব অথবা সাক্ষী হব, যদি সে মুসলমান হয়ে থাকে। [সহীহ মুসলিম ১৩৭৪ (শামিলা), ৩২০৯ (ই. ফা), ৩২৩০ (হা. এ)]।
.
● মদিনা ঈমানের স্থান (ঈমানের গৃহ) :
.
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনাকে দারুল ঈমান বা ঈমানের স্থান (গৃহ) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
.
إِنَّ الْإِيْمَانَ لَيَأْرِزُ إِلٰى الْمَدِيْنَةِ كَمَا تَأْرِزُ الْحَيَّةُ إِلٰى جُحْرِهَا
.
‘ঈমান মদিনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে।’ [সহীহ বুখারী ১৮৭৬ (শামিলা ও তা. পা]। ১৭৫২ (ই. ফা), ১৭৪১ (আ. প্র), মুসলিম ১৪৭, আহমাদ ৯৪৬২]।
.
● মদিনা নিজের মধ্য থেকে নিকৃষ্ট জিনিস বের করে দিবে এবং মদিনার অপর নাম ‘তাবা’ ও ‘তায়বা’ :
.
মদিনায় বসবাসের প্রতি রাসুল (সাঃ) উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি এখানে বসবাসের ফলে দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হলেও ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন এবং মদিনা ছেড়ে যেতে নিরুৎসাহ করেছেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
.
يَأْتِيْ عَلٰى النَّاسِ زَمَانٌ يَدْعُوَ الرَّجُلُ ابْنَ عَمِّهِ وَقَرِيْبَهُ : هَلُمَّ إِلٰى الرَّخَاءِ، هَلُمَّ إِلٰى الرَّخَاءِ، وَالْمَدِيْنَةُ خَيْرٌ لَّهُمْ لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ، وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَا يَخْرُجُ مِنْهُمْ أَحَدٌ رَغْبَةً عَنْهَا إِلَّا أَخْلَفَ اللهُ فِيْهَا خَيْرًا مِّنْهُ أَلَا إِنَّ الْمَدِيْنَةَ كَالْكِيْرِ تُخْرِجُ الْخَبِيْثَ، لَا تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتّٰى تَنْفِيَ الْمَدِيْنَةُ شِرَارَهَا كَمَا يَنْفِي الْكِيْرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ
.
‘মানুষের কাছে এমন এক সময় আসবে, মদিনায় বসবাসরত ব্যক্তি তার চাচাতো ভাই ও আত্মীয়কে বলবে চলো সচ্ছলতার দিকে, চলো সচ্ছলতার দিকে; অথচ মদিনাই তাদের জন্য উত্তম, যদি তারা জানত। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, মদিনার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে যে ব্যক্তিই এখান থেকে বের হয়ে যায়, আল্লাহ সেখানে তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি স্থলাভিষিক্ত করে দেন। সাবধান, মদিনা (কামারের) হাপরের ন্যায় নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে বের করে দেবে। হাপর যেভাবে লোহার ময়লা বের করে দেয়, তেমনি মদিনাও তার মন্দ ব্যক্তিদের বের না করা পর্যন্ত কিয়ামত হবে না।’ [সহীহ মুসলিম ৩৪১৮ (শামিলা), ৩২২২ (ই. ফা), ৩২৩৪ (হা. এ), ৩২১৫ (ই. সে)]।
.
.
❒ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন দিকে (স্থান ও এলাকায়) সফর করা যাবে না :
.
বর্তমান পৃথিবীর নানা মানুষ নানা স্থানে সফর (ভ্রমণ), যিয়ারত (পরিদর্শন) ও পর্যটক হিসেবে গিয়ে থাকেন। বিভিন্ন স্থানের মসজিদে জুম‘আর সালাম আদায়ের উদ্দেশ্যেই গিয়ে থাকেন। অথচ ইসলামে এটাকে স্মপূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেবলমাত্র নিম্নের হাদীসে বর্ণিত তিনটি স্থানের তিনটি মসজিদ ব্যতীত। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
.
لاَ تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلاَّ إِلٰى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ، وَمَسْجِدِ الرَّسُوْلِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَسْجِدِ الْأَقْصٰى
.
‘তিনটি মসজিদ ব্যতীত (আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে) অন্য কোন দিকে সফর করা যাবে না। মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ ও মসজিদুল আক্বসা।’ [সহীহ বুখারী ১১৮৯ (শামিলা ও তা. পা), ১১১৬ ও ১৮৭১, (ই. ফা), সহীহ মুসলিম ১৩৯৭ (শামিলা), ৩২৫৪ (ই. ফা),
.
● আনুসাঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয় :
.
এ হাদিস যে কোন মসজিদ বা অন্য বস্তু যেখানে সে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সফরের নিয়ত করছে, উষ্ট্রী হাঁকাতে নিষেধ করে। কারণ, সুনানে নাসায়ীতে আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমি বুসরা বিন আবী বুসরা আল-গেফারী (রাঃ)-এর সাথে দেখা করেছি। অতঃপর তিনি বলেন, কোথা হতে এসেছেন? আমি উত্তর দিলাম ‘তুর’ হতে। তিনি বললেন, আপনার সেখানে যাওয়ার আগে যদি আমি আপনার সাথে দেখা করতাম, আপনি সেখানে যেতেন না। আমি তাকে বললাম, কেন ? তিনি বললেন, আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি :
.
لَا تُعْمَلُ الْمَطِيُّ إِلَّا إِلٰى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِيْ وَمَسْجِدِ بَيْتِ الْمَقْدِسِ
.
‘আরোহণের পশুকে (আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সফরের কাজে) তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন বস্তুর জন্য ব্যবহার করা যাবে না। মসজিদুল হারাম, আমার মসজিদ এবং বায়তুল মাক্বদিসের মসজিদ।’ [হাদীসের মান : সহীহ। সুনান নাসাঈ ১৪২৯ ও ১৪৩১ (শামিলা), মুয়াত্তা মালিক ১৭ ও ২৪০]। এতে বুসরা বিন আবি বুসরা আল-গিফারী (রা|)-এর দলিল বিদ্যমান আছে, যে এ তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো বস্তুর জন্য আরোহণের উষ্ট্রী ব্যবহার করা যাবে না।
.
.
❒ উপসংহারঃ
.
হে আল্লাহ! হে দয়াময়, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, সকল ক্ষমতার একচ্ছত্র সম্রাট, সর্বভৌমত্তের Power of Attorney General (পাওয়ার অফ এটর্ণী জেনারেল), কা‘বা ও মদিনার রাব্ব, উপরোল্লেখিত, মহিমান্বিত, সর্বগুণে গুনান্বিত, বহুবিদ বিশেষণে ভূষিত, নবী-রাসূলদের স্মিতি বিজড়িত, পূণ্যভূমির মালিক, হে আল্লাহ! আমার মতো ক্ষুদ্র অতি নগন্য, অধম. অক্ষম ও হত-দরিদ্র ব্যক্তিসহ সকলকেই হজ্জ ও উমরাহ পালন করার সামর্থ এবং মক্কা-মদিনার শ্রেষ্টত্বসহ তথায় শেষ নিঃস্বাশ ত্যাগ করার তাওফীক দান কর, আমীন-ছুম্মা আমীন।
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂
.
লেখাঃ আব্দুস সালাম হুসাইন আলী (আল্লাহ্ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)